কুশমণ্ডি মহীপাল দিঘির কিছু কথা-
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তথা কুশমণ্ডি থানার অন্তর্গত পাল যুগের অন্যতম কীর্তি মহীপাল দিঘি। কুশমণ্ডি থেকে তেরো কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত মহীপাল দিঘি রাজা দ্বিতীয় মহীপালের অমর কীর্তি। গভীরতা ও দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এটি দক্ষিণ দিনাজপুরের সব থেকে বড় দিঘি। কিন্তু জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি ও প্রশাসনের অবহেলায় মহীপাল দিঘি আজ বিভিন্ন বেদনায় ভারাক্রান্ত। সেই সুপ্রাচীন নিদর্শন তো দূর অস্ত! কয়েক দশক আগে পর্যন্ত যে গাছ-গাছালি ঝোপঝাড় বাঁশবন দিঘির পাড়ে দেখা যেত, এখন আর তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এখন দিঘির পাড় দিয়ে অসংখ্য বাড়িঘর যা কেবলই জবরদখল বা বেদখলের নামান্তর। জলাভূমির বিস্তীর্ণ এলাকায় আল বেঁধে চলেছে কৃষিকাজ, যা দেখে মনে হতেই পারে বোরো ধানের সবুজ মাঠ।মহীপালের কিছু কথা-
মহীপাল, প্রথম (আনু. ৯৯৫-১০৪৩ খ্রি) পাল বংশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। আট শতকের মাঝামাঝিতে গোপাল বাংলায় পাল বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পাল শাসনের প্রথম দুইশত বছর প্রথম তিনজন রাজার শাসনকাল (প্রায় একশত বছর) ছিল উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগ। পরবর্তী পাঁচজন রাজার পর্যায়ক্রমিক শাসনকালে নেমে আসে পাল বংশের স্থবিরতার যুগ। দেবপাল এর (আনু. ৮২১-৮৬১ খ্রি) উত্তরসূরিগণের শক্তি ও সাহসের অভাব ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরপরই বংশের অভ্যন্তরীণ সংকট দেখা দেয় এবং পালদের জীবনীশক্তিও নিঃশেষ হতে থাকে বলে মনে হয়। তৎকালীন পাল রাজাগণ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন না। প্রথম মহীপালের দুজন পূর্বসূরী দ্বিতীয় বিগ্রহপাল এবং দ্বিতীয় গোপালের শাসনকালে চন্দেল্ল এবং কলচুরিগণ বাংলায় বারংবার অভিযান পরিচালনা করেন। উত্তর ভারতের প্রতীহার সাম্রাজ্যের অবলুপ্তির পর চন্দেল্ল এবং কলচুরিদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সকল বৈদেশিক অভিযান ‘গৌড়পতি’ উপাধি ধারণকারী কাম্বোজ শাসকদের অভ্যুত্থানে সহায়তা করেছিল। উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় এই কাম্বোজ গৌড়পতিগণ মোটামুটিভাবে স্বাধীন শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। প্রথম মহীপালের পূর্বে পাল শাসন কিছু সময়ের জন্য অঙ্গ এবং মগধ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে বলে মনে হয়।মহীপালের পঞ্চম রাজ্যাংকে প্রকাশিত বেলওয়া ও নবম রাজ্যাংকে প্রকাশিত বাণগড় তাম্রশাসনের শ্লোকসমূহে ঘোষণা করা হয় যে, তিনি বাহুদর্প প্রকাশে সকল বিপক্ষীয়কে নিহত করে অনধিকারী কর্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য (রাজ্যম্ পিত্রম্) পুনরুদ্ধার করেন। এখানে পরোক্ষভাবে একটি বিষয় সম্পর্কে জানা যায় যে, মহীপালের ‘রাজ্যম্ পিত্রম্’ (বরেন্দ্র, সন্ধ্যাকর নন্দী উল্লিখিত পালদের ‘জনকভূ’) তাঁর সময়ের কিছু পূর্বেই লুপ্ত হয়েছিল। পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারে মহীপালের সাফল্যই তাঁর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব কেননা এ ঘটনা পাল সাম্রাজ্যকে নবজীবন দান করেছিল।
কুমিল্লা জেলার বাঘাউরা ও নারায়ণপুরে প্রাপ্ত দুটি মূর্তিলিপির সাক্ষ্যে অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও মহীপালের সার্বভৌম ক্ষমতা বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এ যুক্তি গ্রহণ করা বেশ কষ্টকর। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কুমিল্লা অঞ্চলে আবিষ্কৃত দুটি মূর্তিলিপি, যেখানে মহীপালের নাম উৎকীর্ণ আছে, পরবর্তীকালেও অত্র অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকতে পারে। তাই অত্র অঞ্চলে মহীপালের শাসন সম্প্রসারণের প্রমাণ হিসেবে একে গ্রহণ করা চলে না। তদুপরি দশ শতকের প্রথম থেকেই অত্র অঞ্চলে চন্দ্র বংশের ধারাবাহিক শাসনের বিষয়টি বর্তমানে নিঃসন্দেহভাবে প্রতিষ্ঠিত। গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক। রাজেন্দ্র চোলের সৈন্যবাহিনী গোবিন্দচন্দ্রকে বঙ্গালদেশে এবং মহীপালকে উত্তর রাঢ়ে দেখতে পায়।
দক্ষিণ বিহার (মগধ)-এর উপর মহীপালের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। রাজত্বের শেষের দিকে তিনি উত্তর বিহারেও নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। সারনাথ লিপির ভিত্তিতে পন্ডিতগণ বিহারের বাইরেও বিজয়াভিযানের কৃতিত্ব মহীপালের ওপর আরোপ করেন। ১০৮৩ বিক্রম সম্বৎ-এ (১০২৬ খ্রি) উৎকীর্ণ লিপিটি একান্তই ধর্মীয় প্রকৃতির। এ লিপিতে বারাণসীর নিকটবর্তী প্রাচীন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে নতুন নতুন মন্দির নির্মাণ ও পুরাতন মন্দিরাদির সংস্কার সাধনের কথা বলা হয়েছে। কেবল এ লিপির ভিত্তিতে মহীপাল বারাণসী অধিকার করেছিলেন বলে গ্রহণ করা যায় না। ১০২১ থেকে ১০২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় রাজেন্দ্র চোলের অভিযান পরিচালনা সম্পর্কে তথ্য সম্বলিত চোল লিপি (তিরুমুলাই লিপি) তৎকালীন বাংলার অবস্থার ওপর কিছু আলোকপাত করে। লিপিটিতে বলা হয়েছে যে, উড়িষ্যা অভিযানের পর চোল সম্রাট ধর্মপালের (সম্ভবত কাম্বোজ বংশীয় রাজা) ধ্বংস সাধন করে যেখানে রণশূরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় সেখানে পৌঁছেন। এরপর সৈন্যরা বঙ্গালদেশে পৌঁছে, যে দেশে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামে না। এদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র হাতির পিঠ থেকে নেমে দ্রুত পলায়ন করেন। উত্তর রাঢ়ে চোলগণ মহীপালের সাক্ষাৎ পান। চোললিপির বর্ণনার ভিত্তিতে গোবিন্দচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় এবং মহীপাল উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় রাজত্ব করতেন বলে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
ইমাদপুরে প্রাপ্ত মহীপালের দুটি লিপি তাঁর ৪৮তম রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ। সুতরাং দীর্ঘকাল ব্যাপী তিনি ক্ষমতায় ছিলেন বলে মনে হয়। সিংহাসনে অভিষেকের সময় মহীপাল পাল সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ বিহারে সীমাবদ্ধ পান এবং তিনি তাঁর শাসনের প্রথমদিকে কাম্বোজদের কাছ থেকে উত্তর ও পশ্চিম বাংলা পুনরুদ্ধারের জন্য সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। শাসনকালের শেষদিকে তিনি উত্তর বিহারে পাল কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হন। বাংলার পশ্চিম-দক্ষিণের কিছু অংশ, যেখানে রণশূর ও ধর্মপাল শাসন করতেন, ব্যতীত পালদের আদি রাজ্যের ওপর পাল কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপনের জন্য মহীপাল অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার।
শান্তিপূর্ণ ক্রিয়াকর্মের জন্যও মহীপাল সমধিক পরিচিত। বাংলার অনেক দিঘি ও নগরী এখনও তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ, বগুড়া জেলার মহীপুর, দিনাজপুর জেলার মাহীসন্তোষ এবং মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল; দিনাজপুর জেলার মহীপাল দিঘি এবং মুর্শিদাবাদে মহীপালের সাগরদিঘি- এ সবই মহীপালের স্মৃতিবহ এবং প্রমাণ করে যে, বাংলার জনগণের কাছে মহীপালের নাম কতখানি প্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাংলায় বিদ্যমান অসংখ্য লোকগাথায়ও মহীপালের নাম জড়িত ছিল। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভগবত এ (১৫৭২ খ্রি) বলা হয়েছে যে, ষোল শতকের প্রথমার্ধে মহীপালের এসব গীতিকা বাংলার অধিবাসীদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ছিল। গ্রামীণ বাংলায় আজো বিদ্যমান ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত’, এ জাতীয় প্রবাদও মহীপালের নামের জনপ্রিয়তারই পরিচায়ক। সম্ভবত প্রথমদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহের পর মহীপাল শান্তিপূর্ণ কর্মকান্ড এবং ধর্মে-কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। জনহিতকর কার্যাবলীর জন্য তিনি বাংলার জনগণের হূদয়ে স্থান করে নেন। পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষেও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে মহীপালের সময়ে পালশক্তি পুনরুদ্ধারের প্রমাণ পাওয়া যায়। পাহাড়পুরের মূল মন্দির, বৌদ্ধ মঠের প্রকোষ্ঠ এবং সত্যপীর ভিটায় তারা-মন্দিরে অসংখ্য স্তূপ পুনঃসংস্কারে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পাল সাম্রাজ্যের হূতগৌরব পুনরুদ্ধার এবং সাময়িকভাবে অনৈক্যের ধারা প্রতিহত করতে মহীপাল সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তিনি এই বিচ্ছিন্নতার ধারাকে চিরতরে নির্মূল করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর এই সাফল্য পালদের বংশীয় শাসনকে নবজীবন দান করেছিল। সোর্স- banglapedia.org
0 Comments